মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। সাধারণভাবে মানুষের মুড সুইং হয়ে থাকে। কিন্তু প্রায়ই যদি মন খারাপ থাকে, তাহলে তা জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মন-মেজাজ খারাপ বা উত্তেজিত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন মানসিক, শারীরিক ও পরিবেশগত কারণ থাকতে পারে। তবে সচেতনতা ও সঠিক কৌশল অনুসরণ করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
যেকোনো কারণে অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ আমাদের মেজাজ খারাপের অন্যতম কারণ হতে পারে। কাজের চাপ, পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে মনের স্থিরতা নষ্ট হয়
২. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
ঘুম আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্ক ঠিকমতো বিশ্রাম নিতে পারে না, ফলে আমরা সহজেই রেগে যাই, খিটখিটে হয়ে পড়ি বা বিষণ্ণতায় ভুগতে পারি।
৩. অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতা ও ট্রমা
কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা বা মানসিক আঘাত যদি আমাদের মনের মধ্যে বাসা বাঁধে, তাহলে তা অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদী মেজাজ খারাপ বা উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৪. হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা
মানবদেহের কিছু হরমোন যেমন—সেরোটোনিন, ডোপামিন, কর্টিসল ইত্যাদির ভারসাম্য নষ্ট হলে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে গেলে আমরা বেশি উদ্বিগ্ন ও রাগান্বিত হয়ে পড়ি।
৫. পুষ্টির অভাব ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি না পেলে মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। বিশেষত, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব হলে মেজাজ খারাপ হতে পারে।
৬. একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে থাকলে মন খারাপ হয়ে যায়। একাকীত্ব আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মেজাজ খারাপ বা উত্তেজিত থাকার কারণ হতে পারে।
৭. প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারও আমাদের মস্তিষ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নেতিবাচক খবর, অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতা ইত্যাদি মানসিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
সমাধান ও করণীয়
১. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান বা রিলাক্সেশন পদ্ধতি অনুসরণ করলে মন শান্ত থাকে।
২. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমানোর আগে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলা এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
৩. নেতিবাচক চিন্তা দূর করা
নিজের চিন্তাভাবনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। অযথা নেতিবাচক চিন্তা করলে মেজাজ খারাপ হতে পারে। তাই ‘পজিটিভ সেলফ-টক’ এবং সমস্যাকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৪. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত। বিশেষ করে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, চিয়া সিড, মাছ ইত্যাদি খাবার মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।
৫. শারীরিক ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা উচিত। এটি মস্তিষ্কে এন্ডরফিন নামক ‘হ্যাপি হরমোন’ উৎপন্ন করে, যা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৬. সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা
বন্ধু, পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা এবং সমস্যা শেয়ার করলে মানসিক চাপ কমে যায়।
৭. প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম কমানো প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময়ের পর মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার এড়িয়ে চলা ভালো।
৮. পছন্দের কাজ
যে কাজগুলো করতে ভালো লাগে, সেগুলো করার চেষ্টা করা উচিত। গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা বা যেকোনো সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করলে মন ভালো থাকে।
৯. মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
যদি মেজাজ খারাপ বা উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে থাকে এবং দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মন-মেজাজ খারাপ বা উত্তেজিত থাকার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে সঠিক কৌশল অবলম্বন করে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। জীবনযাত্রার কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের কৌশল রপ্ত করলে মন শান্ত থাকবে। তাই সুস্থ মন ও সুন্দর জীবনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে প্রফেশনাল সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :