
চৈত্রের দুপুর। গরমে অবস্থা কাহিল। চারদিকে বৃষ্টির জন্য হাহাকার। কৃষক দবিরের বাড়ির উঠানের আমগাছে একটি দোয়েল পাখি পায়ে ঠোঁট ঘষছে। পাখির মনে আনন্দের সীমা নেই। পাখির জন্য প্রতিটি দিনই ঈদ। তবে দবিরের মন ভালো নেই। এবারের ফলন ভালো হয়েছে কিন্তু দাম তেমন পায়নি। মহাজনদের দেনা মেটাতেই সব পয়সা ফুরিয়ে গেছে।
আট বছরের মেয়ে বলেছিল, ‘আব্বা, এবার আমাকে নতুন জামা কিনে দিয়েন।’ স্ত্রীর আবদার, ‘কত বছর হলো ঈদের দিন নতুন কাপড় পরি না। এবার আমাকে নতুন শাড়ি কিনে দিও।’ দবির মিয়ার নিজেরও ভালো কাপড় নেই। স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে তিনিও একটা নতুন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি কিনবেন ভেবেছিলেন। তবে কেনাকাটা তো দূরের কথা, ঈদের দিন ভালোমন্দ রান্নার জন্য বাজারের টাকাটাও এখন তার হাতে নেই।
এই সময় আকাশের অবস্থা একরকম থাকে না। প্রচণ্ড তেজে সূর্য তেতে ওঠে। আবার একটু পরই মেঘ এসে পুরো আকাশ কালো করে দেয়। বৃষ্টি আসবে আসবে করেও আসে না। কোথাওবা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আবার রোদ উঠে সব গরম করে দেয়। এই মেঘ-রোদের খেলার মতোই যেন আমাদের ঈদের কেনাকাটা। একদিকে দবিরদের ঈদের দিন কী রান্না করবেন সেই চিন্তায় মরছেন। অন্যদিকে রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতে লাখ টাকার কেনাকাটা করেও কারো মন ভরে না। আলমারিতে নতুন শত শত শাড়ি-থ্রিপিছ, গেঞ্জি, শার্ট থাকার পরও আরো নতুন জামাকাপড় চাই। আবার একটি পোশাক একবার গায়ে দেওয়ার পর তা আর গায়ে দেওয়া হয় না এমন মানুষও আছে। এর চেয়ে ভয়াবহ কথা হলো, পোশাক কেনার পর কখনই পরা হয় নাÑ এমন বিলাসিতার অভিশাপও আমাদের কারো কারো আমলনামায় জমা আছে।
একটা সময় দারিদ্র্য আমাদের মাথার মুকুট ছিল। আমরা গর্ব করে বলতাম, নবীজি (সা.) নিজ হাতে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরতেন। খলিফা ওমর (রা.) ঈদের দিন পুরোনো কাপড় ধুয়ে গায়ে দিতেন। হাসান-হোসাইন ঈদের দিন নতুন কাপড় না পেয়ে কান্না করলে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) বেহেশত থেকে কাপড় নিয়ে আসতেন। এগুলো ছিল আমাদের চর্চার বিষয়।
তবে এখন আমাদের আলোচনা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঈদের বাজেট। কার বাজেট কত বেশি এটা দিয়ে ঈদের আনন্দ নির্ধারণ করা হয়। কারো বাজেট যদি লাখ টাকা না হয়, তার মন খারাপ থাকে। পাঁচ-দশ হাজার টাকা বাজেট হলে লজ্জায় কাউকে বলা যায় না। অথচ মুসলমনাদের ঈদের আনন্দের সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক হলো তাকওয়ার। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে কে কত বেশি তাকওয়া অর্জন করতে পেরেছে, এই মানদণ্ডে আনন্দের মাত্রা নির্ধারণ করতেন সালফে সালেহিনরা।
হাদিসে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, ঈদের দিন গোনাহ মাফ হয়েছে কি না এই চিন্তায় ঈদের নামাজ পর্যন্ত পড়তে যাননি হজরত ওমরের মতো সাহাবি। লোকজন বাড়িতে খোঁজ নিতে এসে দেখেন তিনি অঝোরে কাঁদছেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে খলিফা বলেন, ‘তোমরা সবাই এত আনন্দে ফেটে পড়েছ, কিন্তু আমি গোনাহগার আনন্দে যোগ দিই কীভাবে? আমি কি আসমান থেকে গোনাহ মাফের কোনো ঘোষাণা পেয়েছি? আমি কি ক্ষমার কোনো নিশ্চয়তা পেয়েছি? তাহলে আনন্দ করব কোন মুখে?’
তবে দিন যতই যাচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ধর্মের বাঁধন ততই ঢিলে হয়ে পড়ছে। আগেও আমাদের দেশে ঈদ আসত। কিন্তু এভাবে বাজেট নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো না। একদিকে আমরা লাখ টাকার শপিং করে বাড়ি ফিরছি, অন্যদিকে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী একমুঠো খাবারের জন্য লড়াই করছে। আমাদের আলমারিতে কাপড় ধরে না আর ওদের গায়ে কাপড় জোটে না। আমাদের দস্তরখানে কেজিতে কেজিতে খাবার অপচয় হয় আর ওরা দিনের পর দিন উপোস থেকে মরে। মুসলমানের সমাজে এ ধরনের বৈষম্য থাকতে পারে না।
রোজা এসেছে দরিদ্রের দুঃখ অনুধাবন করানোর জন্য। সারা দিন না খেয়ে থাকার কী যন্ত্রণা সেটা ধনীকে বোঝাতে চান আল্লাহ তায়ালা। একবেলা না খেয়ে থাকার কষ্ট যখন মানুষ বুঝতে পারবে, তখন তার কাছে দুনিয়ার হাকিকত পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে সম্পদের জাকাত দেবে। গরিবকে ফেতরা দেবে। এ ছাড়া ঐচ্ছিক দানের হাত সে খুলে দেবে। দরিদ্রকে সঙ্গে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইফতার করবে, সাহরি খাবে। সমাজ থেকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ঘুচে যাবে। আর এটাই হলো সত্যিকারের ঈদ।
যখন সমাজে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকবে না, তখন প্রতিটি দিনই ঈদ হিসেবে ধরা দেবে মানুষের সমাজে। যেমন কৃষক দবিরের আমগাছের দোয়েল পাখির প্রতিটি দিনই ঈদ। কেননা পাখির সমাজে সবাই সমান। সেখানে কেউ ধনী, কেউ গরিবÑ এ বৈষম্য নেই। কারো দশতলা দালান আর কেউ সড়কের এক পাশে ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য দেখা যায় না। কেউ পেটপুরে খেয়ে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াচ্ছে আর কেউ খেতে না পারার যন্ত্রণায় কাতরে মরছেÑ এমনটা নেই।
হে আল্লাহ, আপনি আমাদের জীবনে সত্যিকারের ঈদ এনে দিন। আমাদের সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করে দিন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :