ডুবন্ত পদ্মা ব্যাংক টেনে তোলার উদ্যোগ


আজকের দেশ ২৪ প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৯, ২০২৫, ১:২৩ পূর্বাহ্ণ
ডুবন্ত পদ্মা ব্যাংক টেনে তোলার উদ্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সংকটে পড়া পাঁচ বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর এবার ডুবন্ত পদ্মা ব্যাংক টেনে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির সব আর্থিক সূচক সর্বনি¤œ থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব সাইট সুপারভিশন একীভূত বা অবসায়নের মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যাংক রেজ্যুলেশন ডিপার্টমেন্টকে সুপারিশ করেছেন।
পাশাপাশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এসব সূচকে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক, ঋণের ৯২ শতাংশ খেলাপি, সুদ আয় ঋণাত্মক এবং তারল্য ঘাটতিসহ সব আর্থিক সক্ষমতা সূচকে অবস্থা সংকটাপূর্ণ। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ অবস্থা উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। এসব কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার সুপারিশ করেছে। তবে এটি কোন ব্যাংকের সঙ্গে করা হবে তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সুপারভিশন বিভাগ ব্যাংকটির পর্যালোচনা করে তা জানাবে। ২০১২ সালে ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

অনিয়ম আর লুটের কারণে ধ্বংস বয়ে যায় সেই ফারমার্স। পরে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকটিতে নতুন জীবন দেওয়া হবে। ফারমার্স থেকে নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মার ওপর থেকেও নজর সরায়নি। ব্যাংকটিকেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের জন্য ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা শুধু পদ্মা ব্যাংক থেকেই ৫ হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ প্রায় ৯২ শতাংশ। তাদের এ অপরাধকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘নৈতিকস্খলন’ হিসেবে উল্লেখ করে।
ব্যাংকের অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে একপর্যায়ে গ্রাহকরা শাখায় ভিড় করেও নিজেদের জমানো টাকা ফেরত পাননি। এমনকি সরকারের জলবায়ু তহবিলের অর্থও ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ব্যাংকটি। পরিস্থিতির অবনতির কারণে ২০১৭ সালে মখা আলমগীরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সরকারের হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়।
পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় প্রভাবশালী নেতা ড. মহীউদ্দীন খান (মখা) আলমগীর প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা লুট করে। তার সহযোগী বাবুল চিশতির মাধ্যমে লুট হয় আরও প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা। এভাবেই পদ্মা ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়।
সংকটে পড়া ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) হাতে প্রায় ৭০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করে ৭১৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮ সালে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে কিছু সময় ব্যাংকটি স্থিতিশীলতা ফিরে পেলেও পরবর্তীতে নতুন করে লুটপাট ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে সরাফাতও পদত্যাগ করে বিদেশে অবস্থান করছেন।
জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওরফে মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। সংস্থাটির সর্বশেষ তদন্তে দেখা গেছে, তার নিজের নামে, স্ত্রী সিতারা আলমগীরের নামে এবং পরিবারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোট ৩৯৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জমা হয়েছে এবং ১৯৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আদালতের নির্দেশে এসব অ্যাকাউন্ট পুনরায় স্থগিত করা হয়েছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, মখা আলমগীর মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয় এবং ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা নয়-ছয় করা হয়। কখনো নিজের নামে, কখনো স্ত্রীর নামে আবার কখনো তথাকথিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব অবৈধ কার্যক্রমে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ছাড়াও আইএফআইসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ব্যবহৃত হয়েছে।
এর মধ্যে বাবুল চিশতির সাজা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মখা আলমগীর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা দূরে থাক, ভয়ে কেউ কথা বলারও সাহস পাননি। একটি সূত্রের দাবি, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন মখা আলমগীর।
তদন্তে উঠে এসেছে, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের জন্য বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শুভ অটোরাইস মিল, সুলতানা ফিলিং স্টেশন, মেসার্স সুলতানা অয়েল মিল, গুলবাহার হিমাগার লিমিটেড ও সুলতানা ফাউন্ডেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন নিয়ে তা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা এবং আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, মখা আলমগীর ও তার স্ত্রী প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২(শ) (১৯) ধারায় কর-সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অধিকতর অনুসন্ধান, তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাহবুবুল হক চিশতি ওরফে বাবুল চিশতি ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতিকে ব্যাংকটির প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে ১২ বছর কারাদ- দেন আদালত।
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ছিল ৫ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই ছিল খেলাপি। গত বছরের একই সময় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। ব্যাংক মোট ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে মাত্র ১১ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে।
চলতি বছরের জুনে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় ছিল ৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে ঋণাত্মক ১৫০ দশমিক ২৭ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক কাঠামো ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী থাকা উচিত ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ। সিআরএআর হচ্ছে, একটি ব্যাংকের মূলধন ও তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত, যেখানে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সম্পদের হিসাব নির্ধারণ করা হয়।
ব্যাংকটির ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে পদ্মা। পাশাপাশি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকের আস্থা তলানিতে পৌঁছেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ব্যাংক সুদ থেকে আয় করেছে মাত্র ৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ সময় সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ৬৭৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
গত বছর নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হয় ৬২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ফলে গত বছর ব্যাংকের সব মিলিয়ে লোকসান হয়েছে ৯৬৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে নিট সুদ আয় ৪০৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক। এ ছয় মাসে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫০৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের মোট ৬০টি শাখার মধ্যে ৫৯টি লোকসানে।
বিদ্যমান নিয়মে একটি ব্যাংকের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের (বেশিরভাগই আমানত) চার শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে হয়। আর সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ রাখতে হয় ১৩ শতাংশ। তবে ব্যাংক সেই অনুযায়ী তারল্য রাখতে পারছে না। তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের বর্তমান সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি যথাক্রমে ১৭৩ কোটি এবং ২১৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে একটি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় থেকে আমানতকারীদের কিছু কিছু অর্থ ফেরত দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।